মোহাম্মদ আলী একজন অকুতভয় সৈনিকের নাম । যিনি শুধু দুনিয়া সেরা বক্সারই ছিলেন না, ছিলেন একজন মানবিক মানুষ, ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার একজন মানুষ । নিজের ক্যারিয়ার, জীবন বিপন্ন হবে জেনেও অন্যায়, অসত্য, অত্যাচেরের বিরুদ্ধে সারা জীবন প্রতিবাদ করে যাওয়া একজন মানুষ ।
‘ভিয়েতনামের মানুষের সঙ্গে আমার কোনো ঝগড়া নেই। শুধু সাদা চামড়ার মানুষের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য ১০ হাজার মাইল দূরের কোনো দেশে গিয়ে মানুষের ওপর অত্যাচার করা, খুন করা, বোমা ফেলা এই কাজে আমি যুক্ত হব না। পৃথিবীর বুকে এসব অবিচার বন্ধ হওয়া উচিত।’
কথাগুলো বলছিলেন এমন একজন মানুষ, যাঁর ছিল মানবতার প্রতি ভালোবাসা, খেলlর ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারে জেনেও তিনি এই কথাগুলো বলেছিলেন। দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। খেলার লাইসেন্স সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ হয়েছিল। গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন।
অলিম্পিকে স্বর্ণ পদক জয়ী খেলোয়াড় হওয়ার পরও রোমের একটি রেস্টুরেন্ট মোহাম্মদ আলীকে খাবার দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয় ।
তার পরও মানবতার বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো কাজ করেননি। মানুষটি আমাদের সবার প্রিয় বক্সার মোহাম্মদ আলী । তাকে বলা হয় সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রীড়াবিদ । আজ সংক্ষিপ্ত পরিসরে তুলে ধরবো প্রিয় এই মানুষটির জীবনী ।
ক্যাসিয়াস মার্কাস ক্লে, ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আগে এটাই ছিল তাঁর নাম। ১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারি লুইসভিল কেন্টাকিতে আলী আফ্রিকান-আমেরিকান মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ক্যাসিয়াস মার্কাস ক্লে সিনিয়র ছিলেন সাইনবোর্ড বিলবোর্ড পেইন্টার। মা গৃহিণী।
আলীর বক্সিংয়ে আসাটা ছিল অনেকটা নাটকীয়। ১২ বছর বয়সে আলী এক সাইকেল চোরকে ধরেন। ধরার সময় চোরকে এমনভাবে ঘুসি মারেন, যেটা দেখে লুইসভিল থানার পুলিশ অফিসার জো মার্টিন মুগ্ধ হয়ে যান। এই মার্টিনই আলীর প্রথম বক্সিং কোচ।
১৯৬০ সালের ২৯ অক্টোবর ১৮ বছর ২৮৬ দিনে মোহাম্মদ আলীর বক্সিং রিংয়ে অভিষেক হয়, প্রতিপক্ষ ছিল টানি হানসেকার। তারপর ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ১৯টি ম্যাচ খেলে সবগুলোতেই জেতেন। এর মধ্যে ১৫টি জয় ছিল ‘নক আউটে’।
সে সময় আলী জিম রবিনসন, হেনরি কুপার, জর্জ লোগান, আলন্সো জনসন ও জনি ফ্লি ম্যানের মতো বক্সারদের হারান। ১৯৬২ সালে হারান আর্চি মুরকেও। ১৯৬৩ সালে আলী ও ডাগ জোন্সের ম্যাচটি ছিল ‘ফাইট অব দি ইয়ার’। ম্যাচটি হয়েছিল নিউইর্য়কের ‘ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে’।
বাংলাদেশে এসে মোহাম্মদ আলী এত খুশি হয়েছিলেন, ফিরে গিয়ে সবাইকে বলেছিলেন, ‘স্বর্গ দেখতে চাইলে বাংলাদেশে যাও।’
আলীর জন্য সেই ম্যাচটি ছিল সবচেয়ে কঠিন ম্যাচ। ১০ রাউন্ড পর্যন্ত দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। শেষ পর্যন্ত আলী জেতেন। ১৯৬৩ সালের শেষের দিকে ওয়ার্ল্ড হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপের অন্যতম দাবিদার ছিলেন।
সে সময় হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন ছিলেন সনি লিস্টন। শুধু দুর্দান্ত বক্সারই নন, অপরাধী হিসেবে পুলিশের খাতায় নামও ছিল তাঁর। আলীর সঙ্গে লড়াইয়ের দিন ঠিক হয় ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪।
আলী ছিলেন আন্ডারডগ, কিন্তু তার পরও ম্যাচ শুরুর আগে আলী লিস্টনকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘ও বিশাল কদর্য একটা ভালুক। ওর শরীর থেকে অনেক সময় ভালুকের গন্ধ বের হয়। হারানোর পর তাকে আমি চিড়িয়াখানায় দান করব।’
মানসিকভাবে লিস্টনকে বিপর্যস্ত করার জন্যই আলী এই কথার লড়াই শুরু করেছিলেন। ম্যাচের আগে আলী চিৎকার করে সবাইকে বলতে থাকেন, আজ বক্সিং রিংয়ে কেউ একজন মারা যাবে! শেষ পর্যন্ত সপ্তম রাউন্ডে গিয়ে আলী লিস্টনকে ‘নক আউট’ করেন। এটি ছিল সেই সময় বক্সিং রিংয়ে সবচেয়ে বড় আপসেট।
অবশ্য পরে আলীর সেরা প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন জো ফ্রেজিয়ার। আলী-ফ্রেজিয়ারের লড়াই সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ টিভিতে দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল।
১৯৬০ সাল ছিল আলীর জীবনের স্মরণীয় একটি বছর। রোম অলিম্পিকে বক্সিংয়ে সোনা জেতেন। অলিম্পিকে স্বর্ণ পদক জয়ী খেলোয়াড় হওয়ার পরও রোমের একটি রেস্টুরেন্টে তাঁকে খাবার দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। ‘অপরাধ’ তিনি ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ!
রাগে, দুঃখে, অপমানে আলী অলিম্পিক মেডেলটি টাইগ্রিস নদীতে ফেলে দেন। ১৯৬১ সালে আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মালেক এল শাহাবাজের (ম্যালকম এক্স) অনুপ্রেরণায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তার পর থেকে পরিচিত হন ‘মোহাম্মদ আলী’ নামে।
নতুন পরিচয় সবাই সহজভাবে নিতে পারল না। বড় বড় স্পনসর মুখ ফিরিয়ে নিল। ১৯৬৭ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যাওয়ার ডাক এল, কিন্তু তিনি মানবতার পক্ষে থেকে যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করেন। তাঁকে জেলে পাঠানো হয়।
১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন অনেকের চোখের সর্বকালের সেরা এই ক্রীড়াবিদ। বিমানবন্দরে আলীকে স্বাগত জানাতে লাখ লাখ মানুষ উপস্থিত হয়েছিল। সেই সময় বাংলাদেশের নাগরিকত্বও দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশে এসে এত খুশি হয়েছিলেন, ফিরে গিয়ে সবাইকে বলেছিলেন, ‘স্বর্গ দেখতে চাইলে বাংলাদেশে যাও।’
১৯৮১ সালে এই মহান বক্সার অবসর গ্রহণ করেন।
অবশ্য এরপরও আলী লড়ে গেছেন অনেকদিন । লড়তে হয়েছে তাঁকে পারকিনসন রোগের সঙ্গে । যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার একটি হাসপাতালে ২০১৬ সালের ৩ জুন ৭৪ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন কিংবদন্তী এই বক্সার ।
মোহাম্মদ আলীর জীবনী নিয়ে হলিউডে একাধিক সিনেমাও নির্মিত হয়েছে। এরমধ্যে দ্য সুপারফাইট, দ্য গ্রেটেস্ট, ফ্রিডম রোড এবং আলী উল্লেখযোগ্য।
মোহাম্মদ আলীর জীবনী নিয়ে ২০০১ সালে মুক্তি পায় সাড়া জাগানো সিনেমা ‘মোহাম্মদ আলী’। ওই সিনেমায় মোহাম্মদ আলীর চরিত্রে অভিনয় করে অস্কার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন মার্কিন অভিনেতা উইল স্মিথ।
আপনার আশে পাশে যদি এমন কোন মানুষ থাকে যার এই লেখাটি পড়া উচিত বলে মনে করেন , তার সাথে অবশ্যই শেয়ার করবেন ।
অনুপ্রেরণামূলক গল্প, সফল ব্যক্তিদের জীবনী, সফলতার সূত্র এবং জীবনের নানান সমস্যা আপনাদের পাশে আছে পাই ফিঙ্গার্স মোটিভেশন । আর আগামী পর্বে আপনি কোন বিষয়ে লেখা চান কমেন্ট করে জানান । ভাল থাকুন ।
সফলতা কেবল আপনার জন্যই ।