সোহাগ হাওলাদার ! একজন ভবিষ্যৎ ডাক্তার । ইতোমধ্যে আপনারা অনেকেই হয়ত চেনেন তাকে । হাজার সীমাবদ্ধতাকে জয় করে অনুপ্ররনার এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছেন তিনি । পড়ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে ফাইনাল ইয়ারে ।
চলুন সোহাগ হাওলাদা এর নিজের মুখেই শুনে আসি তাঁর হার না মানা জীবনের গল্প ।
ঢাকা মেডিকেলে পড়ার সৌভাগ্য হবে কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। এখনো ভাবতে অবিশ্বাস্য লাগে যে আমার কাছে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম কেনার টাকা পর্যন্ত ছিলনা। এমন দিনও আমাকে পার করে আসতে হয়েছে।
দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে কেটেছে শৈশব। বাবার সাথে ক্ষেতে কাজ করা,রাতে মাছ ধরতে যাওয়াই ছিল আমার প্রতিদিনের কাজ। আর দশটা ছেলের মত বিকেলে খেলাধুলা করার সময় হয়নি কখনো। কিভাবে ২ বেলা খাবার যোগাড় করব তাই ছিল প্রধান লক্ষ্য। তবুও মনের মধ্যে একটা জেদ কাজ করত যে পড়াশুনা আমাকে করতেই হবে,বড় আমাকে হতেই হবে।
তাই সারাদিনের ক্লান্ত পরিশ্রমের পর রাতে হারিকেনের আলোয় যখন পড়তে বসতাম ক্লান্ত শরীর সায় না দিলেও মনের জোরে পড়তে বসতাম। অভাব অনটনের সংসারে যেখানে দুবেলা দুমুঠো ভাতই যোগাড় হয় না ঠিকমতন,সেখানে পড়াশুনা করা তো বিলাসিতা।
বাবার সাথে ক্ষেতে কাজ করা,রাতে মাছ ধরতে যাওয়াই ছিল আমার প্রতিদিনের কাজ
আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি, ফেব্রুয়ারি মাসে মা মারা যান । মা হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন । এক কোয়াক ডাক্তার মার চিকিৎসা করেন। টাকার অভাবে মার ভাল চিকিৎসা করাতে পারিনি। মা কি রোগে মারা গেছিলেন তখন বুঝিনি। মেডিকেলে পড়ে এখন বুঝতে পারছি মা স্ট্রোক এ মারা গেছিলেন।
মা তো মারা গেলেন কিন্তু রেখে গেলেন ২২দিন বয়সের বোনকে। ও ছাড়াও আমরা তখন চার ভাইবোন, আমি বড় তারপর দুই বোন তারপর ছোট ভাই। আমাদের যেখানে জীবন ধারণ অনেক কষ্টের, সেখানে ওকে লালনপালন করা অনেক দুস্কর হয়ে গেল।
তাই ওকে এক নি:সন্তান দম্পতি নিয়ে গেল, এই শর্তে যে কোন দিন বোন বলে পরিচয় দিতে পারবো না। মা মারা যাওয়ার ৬ মাস পরে বাবা আবার বিয়ে করলেন। এক বোনকে আমার এক বড়লোক খালা নিয়ে গেলেন। কাজের মেয়ের মত ব্যবহার করতেন। তাদের সাথে খেতে দিতেন না, রান্নাঘরে থাকতে দিতেন। আমি ক্লাস ফোরের বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে, সবার সিদ্ধান্তে পড়াশুনা বন্ধ করে নারায়নগঞ্জে ওয়ার্কশপে কাজ করতে যাই যাতে বাবাকে আর্থিক সাপোর্ট দিতে পারি।
অভাব অনটনের সংসারে যেখানে দুবেলা দুমুঠো ভাতই যোগাড় হয় না ঠিকমতন,সেখানে পড়াশুনা করা তো বিলাসিতা
ওয়ার্কশপে সকাল ৮ টা থকে রাত ২টা পর্যন্ত কাজ করতে হতো। আমার সামনে দিয়ে আমার বয়সি ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেত, তাদের দেখে আমার চোখে পানি এসে যেত।
৬ মাস পরে আমি বাড়িতে বেড়াতে আসি। ওয়ার্কশপে ফিরে যাবার আগের দিন আমার এক বন্ধু আমাকে স্কুলে যাবার জন্য উৎসাহ দিয়ে স্কুলে নিয়ে গেলো। স্কুলের বন্ধুদের দেখে আমার আর তাদের সঙ্গ ছাড়তে ইচ্ছে হলনা। স্যারদের কাছ থেকে বই নিয়ে বাড়িতে যাই।
বাড়ি এসে যখন বললাম আমি আবার স্কুলে যাব,পরিবারের সবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। আমার সৎ মা আর বাবা আমাকে আবার ওয়ার্কশপে কাজে যেতে বললেন। বাসায় থাকতে দিলেন না। তাই পাশের এক বাসায় লজিং থাকলাম, তাদের দুই বাচ্চাকে পড়াতে হবে আর পড়াশুনার খরচ আমাকেই চালাতে হবে। আমি শুক্রবার জমিতে দিনমজুরের কাজ করতাম ২০ টাকার বিনিময়ে, বড়দের দিতো ৫০ টাকা।
শুক্রবার রাতে মাছ ধরতাম। সারারাত নৌকা চালাতাম আরেক জন মাছ কোপাতো টেরা দিয়ে। এভাবে যে টাকা পেতাম তাই দিয়ে পড়াশুনার খরচ চালাতে হত। সবার মতকে উপেক্ষা করে ৬ মাস গ্যাপ দিয়েই ক্লাস ফাইভ ফাইনাল দিলাম । বৃত্তি পরীক্ষার গাইড কেনার জন্য বাড়ির এক চাকরিজীবীর কাছে টাকা চেয়েছিলাম, তার তাচ্ছিল্যের হাসি এখনো চোখে ভাসে। যে সারাদিন মাঠে কাজ করে সে করবে পড়াশুনা?
আমি শুক্রবার জমিতে দিনমজুরের কাজ করতাম ২০ টাকার বিনিময়ে, বড়দের দিতো ৫০ টাকা
জিদ চেপে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে পড়তে থাকি। পরে ৫০ টাকা দিয়ে আমার এক সিনিয়র এর কাছ থেকে পাঞ্জেরী বৃত্তি গাইড কিনি। বেশি রাফ খাতা কেনার টাকা ছিল না। পুরোনো খাতার এমন কোন জায়গা নেই যেখানে লেখিনি। প্রয়োজনে এক লেখার উপর আবার লিখেছি।
এত কষ্টের পর যখন প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করি, তখন স্যারদের সুনজরে আসি। এই বৃত্তি পাওয়াটাই ছিল আমার পড়াশুনার টার্নিং পয়েন্ট। এরপর টিউশনি করে পড়াশুনা চালিয়ে গিয়েছি।
অষ্টম শ্রেণীতে সাধারন বৃত্তি পাই। এস এস সি তে GPA 4.88 এবং এইচ এস সি তে GPA 5.00 পেয়ে ঢাকায় আসি। কোচিং করার সামর্থ্য ছিল না। পরে রুমের ফ্যান বিক্রি করে কোচিং এর টাকা পরিশোধ করি। অসহনীয় গরমে কিভাবে যে পড়াশুনা করেছি তা বলে বুঝাতে পারব না।
ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাই প্রথমে। মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের টাকা ছিল না। বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার করে পরীক্ষা দিয়ে আল্লাহর রহমতে ১৮২ তম হয়ে ঢাকা মেডিকেলে চান্স পাই। এখন যে মানুষগুলো আমাকে তাচ্ছিল্য করত তারাই আমাকে অনেক গুরুত্ব দেয়।গ্রামের সবার যে কোন সমস্যায় আমার ডাক পড়ে।
আমিও গ্রাম থেকে ঢাকা মেডিকেলে আসা রোগীদের যথাসাধ্য চেষ্টা করি সাহায্য করার। মনে এক অন্যরকম প্রশান্তি আসে। আমি যখন থার্ড ইয়ার এ পড়ি, তখন আমার ওয়ার্কশপের মালিক ঢাকা মেডিকেলে এসে আমাকে ফোন দিলে আমি তাকে ডাক্তার দেখিয়ে দেই।
আল্লাহ আমাকে মানুষের সেবা করার যে মহান সুযোগ করে দিয়েছেন, প্রার্থনা করি যেন সে সুযোগকে আমি কাজে লাগাতে পারি। আমি কোন দিন আর্থিক স্বাধীনতা পাইনি, তাই বলে কোথাও থেমে যাই নি। ভারতীয় লেখক চেতন ভগতের একটা কথা আছে,
“When you fly high,
people will throw stones at you.
Don’t look down.
Just fly higher as the stones won’t reach you”
-এটাই আমার জীবনের মূলমন্ত্র।
আপনার আশে পাশে যদি এমন কোন মানুষ থাকে যার এই লেখাটি পড়া উচিত বলে মনে করেন , তার সাথে অবশ্যই শেয়ার করবেন । অনুপ্রেরণামূলক গল্প, সফল ব্যক্তিদের জীবনী, সফলতার সূত্র এবং জীবনের নানান সমস্যা আপনাদের পাশে আছে পাই ফিঙ্গার্স মোটিভেশন । আর আগামী পর্বে আপনি কোন বিষয়ে লেখা চান কমেন্ট করে জানান । ভাল থাকুন ।
সফলতা কেবল আপনার জন্যই ।
Leave a Reply