যদি প্রশ্ন করা হয়, এই পৃথিবীর সবচেয়ে স্বপ্নবান মানুষটি কে ? কোনো রকম বির্তক ছাড়াই যে নামটি আসবে তা হলো স্টিভ জবস । একজন প্রকৃত স্বপ্নদ্রষ্টা, সফল উদ্যোক্তা এবং একজন নিষ্ঠাবান মানুষ বলতে আসলে যা বুঝায় স্টিভ জবস আসলে তাই ।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে ২০০৫ সালের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন তিনি । অসাধারণ কথামালার এবং অনুপ্রেরণা মূলক একটি বক্তৃতা ছিলো এটি । এই কালজয়ী বক্তৃতাটিকে আমরা তিন পর্বে সাজিয়েছি । আজ থাকছে প্রথম পর্বটি । পড়ুন এবং শেয়ার করে কাছের মানুষদের পড়তে উৎসাহিত করুন ।
পর্ব -১ঃ
পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে আসতে পেরে আমি অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করছি। আমি কখনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করিনি। সত্যি কথা বলতে, আজই আমি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান খুব কাছ থেকে দেখছি। আজ আমি তোমাদেরকে আমার জীবনের তিনটি গল্প বলবো। শুধু তিনটি গল্প।
প্রথম গল্পটি কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা এক সূতোয় বাঁধা নিয়ে ।
রিড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার ছয় মাসের মাথায় আমি পড়ালেখা ছেড়ে দেই । কেন আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়েছিলাম? ঘটনার শুরু আমার জন্মেরও আগে থেকে। আমার আসল মা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অবিবাহিতা তরুণী ।
আমাদের একটা অপ্রত্যাশিত ছেলে শিশু আছে, আপনারা কি ওকে নিতে চান
আমার জন্মের আগে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি আমাকে দত্তক দিবেন। মা খুব চাচ্ছিলেন আমাকে যারা দত্তক নিবেন তাদের যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী থাকে। তো একজন আইনজীবি এবং তাঁর স্ত্রী আমাকে দত্তক নেওয়ার জন্য রাজি হলো। কিন্তু আমার জন্মের পর তাঁদের মনে হলো তাঁরা আসলে একটি কন্যা শিশু চাচ্ছিলেন।
অতএব আমার বর্তমান বাবা-মা, যারা অপেক্ষমাণ তালিকাতে ছিলেন, গভীর রাতে একটা ফোন পেলেন – ”আমাদের একটা অপ্রত্যাশিত ছেলে শিশু আছে, আপনারা কি ওকে নিতে চান?”
তারা অত্যন্ত দ্রুত স্মমতি জ্ঞাপন করল। আমার আসল মা পরে জানতে পেরেছিলেন যে আমার নতুন মা কখনো বিশ্ববিদ্যালয় আর নতুন বাবা কখনো হাই স্কুলের গন্ডি পেরোননি।
প্রথমে তিনি দত্তক নেবার কাগজপত্রে সই করতে রাজী হননি। কয়েক মাস পরে অবশ্য রাজী হয়েছিলেন, কারণ আমার নতুন বাবা-মা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে তারা একদিন আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন।
তোমাকে অবশ্যই তোমার ভালবাসার কাজটি খুঁজে পেতে হবে।
১৭ বছর পর আমি সত্যি সত্যিই বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। এবং আমার নিম্ন মধ্যবিত্ত পিতামাতার সব জমানো টাকা আমার পড়ালেখার খরচের পেছনে চলে যাচ্ছিলো। ছয় মাস এভাবে যাওয়ার পর আমি এর কোন মানে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। জীবনে কী করতে চাই সে ব্যাপারে আমার তখনো কোন স্পষ্ট ধারণা ছিলোনা, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা এ ব্যাপারে কিভাবে সাহায্য করবে সেটাও আমি বুঝতে পারছিলাম না।
অথচ আমি আমার বাবা-মা’র সারা জীবনের জমানো সব টাকা এর পেছনে দিয়ে দিচ্ছিলাম। তাই আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং আশা করলাম যে সবকিছু আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।
ওই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এটা একটা ভয়াবহ সিদ্ধান্ত মনে হতে পারে, কিন্তু এখন পেছন ফিরে তাকালে মনে হয় এটা আমার জীবনের অন্যতম সেরা সিদ্ধান্ত ছিলো।
যেই মুহুর্তে আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিলাম সেই মুহুর্ত থেকে আমি আমার অপছন্দের, অথচ ডিগ্রীর জন্য দরকারী কোর্সগুলো নেওয়া বন্ধ করে দিতে পারলাম, এবং আমার পছন্দের কোর্সগুলো নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়ে গেলো।
জীবনে কী করতে চাই সে ব্যাপারে আমার তখনো কোন স্পষ্ট ধারণা ছিলোনা…
অবশ্য ব্যাপারটি অতোটা সুখকর ছিলোনা। ছাত্র হলে আমার কোন রুম ছিলোনা, তাই আমি আমার বন্ধুদের রুমে ফ্লোরে ঘুমাতাম। ব্যবহৃত কোকের বোতল ফেরত দিয়ে প্রতি বোতলের জন্য আমি পাঁচ সেন্ট করে পেতাম (প্রতি বোতল) যেটা দিয়ে আমি আমার খাবার কিনতাম।
প্রতি রবিবার আমি সাত মাইল হেঁটে শহরের অপর প্রান্তে অবস্থিত হরে কৃষ্ণ মন্দিরে যেতাম শুধুমাত্র একবেলা ভালো খাবার খাওয়ার জন্য। আমার কৌতুহল এবং ইনটুইশন অনুসরণ করে আমার জীবনে আমি যতোকিছু করেছি পরবর্তীতে সেটাই আমার কাছে মহামূল্যবান হিসেবে প্রতিফলিত হয়েছে।
পড়ুন- বিজ্ঞানের রাজপুত্র আলবার্ট আইনস্টাইনের জীবনী
তোমাকে কিছু না কিছুর উপর বিশ্বাস করতেই হবে – তোমার মন, ভাগ্য, জীবন, কর্ম, কিছু একটা।
একটা উদাহরণ দিইঃ সেই সময় রীড কলেজ সম্ভবত দেশের সেরা ক্যালিগ্রাফী কোর্সগুলো করাতো। ক্যাম্পাসের প্রত্যেকটি পোস্টার, প্রতিটি লেবেল করা হতো হাতে করা ক্যালিগ্রাফী দিয়ে। যেহেতু আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম না, তাই আমি যেকোনো কোর্স নিতে পারতাম। তাই ভাবলাম ক্যালিগ্রাফী কোর্স নিয়ে ক্যালিগ্রাফী শিখবো।
আমি সেরিফ এবং স্যান সেরিফ টাইপফেইস শিখলাম, বিভিন্ন অক্ষরের মধ্যে স্পেস কমানো বাড়ানো শিখলাম, ভালো টাইপোগ্রাফী কিভাবে করতে হয় সেটা শিখলাম। ব্যাপারটা ছিলো দারুণ সুন্দর, ঐতিহাসিক, বিজ্ঞানের ধরাছোঁয়ার বাইরের একটা আর্ট। এবং এটা আমাকে বেশ আকর্ষণ করতো।
প্রতি রবিবার আমি সাত মাইল হেঁটে শহরের অপর প্রান্তে অবস্থিত হরে কৃষ্ণ মন্দিরে যেতাম শুধুমাত্র একবেলা ভালো খাবার খাওয়ার জন্য।
এই ক্যালিগ্রাফী জিনিসটা কখনো কোনো কাজে আসবে এটা আমি ভাবিনি। কিন্তু, দশ বছর পর যখন আমরা আমাদের প্রথম ম্যাকিন্টস কম্পিউটার ডিজাইন করি তখন এর পুরো ব্যাপারটাই আমাদের কাজে লেগেছিলো। ম্যাক কম্পিটার টাইপোগ্রাফী সমৃদ্ধ প্রথম কম্পিটার।
আমি যদি দশ বছর আগে সেই ক্যালিগ্রাফী কোর্সটা না নিতাম তাহলে ম্যাক কম্পিউটারে কখনো মাল্টিপল টাইপফেইস এবং আনুপাতিক দূরত্বের ফন্ট থাকতো না। আর যেহেতু উইন্ডোজ ম্যাক এর এই ফন্ট নকল করেছে, বলা যায় কোনো কম্পিউটারেই এই ধরণের ফন্ট থাকতো না।
তুমি কখনোই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকে এক সূতায় বাঁধতে পারবেনা।
আমি যদি বিশ্ববিদ্যালয় না ছাড়তাম তাহলে আমি কখনোই ওই ক্যালিগ্রাফী কোর্সে ভর্তি হতাম না, এবং কম্পিউটারে হয়তো কখনো এতো সুন্দর ফন্ট থাকতো না। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় এই সব বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকে এক সুতোয় বাঁধা অসম্ভব ছিলো, কিন্তু দশ বছর পর সবকিছু একেবারে পরিস্কার বোঝা গিয়েছিলো !
তুমি কখনোই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকে এক সূতায় বাঁধতে পারবেনা। এটা শুধুমাত্র পেছনে তাকিয়েই সম্ভব। অতএব, তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো ভবিষ্যতে কোন না কোন সময় ভালো পরিণামের দিকে যাবে ।
তোমাকে কিছু না কিছুর উপর বিশ্বাস করতেই হবে – তোমার মন, ভাগ্য, জীবন, কর্ম, কিছু একটা। এই বিশ্বাস আমাকে কখনোই ব্যর্থ করে দেয়নি, বরং আমার জীবনের সব বড় অর্জনে বিশাল ভুমিকা রেখেছে।