একটু চিন্তা করুন তো। এই মানুষটাকে আপনি চেনেন না, জানেন না , তার বংশ পড়াশুনা কোন কিছুই আপনার অবগত না তবুও মানুষটির সাথে দুই মিনিট কথা বলে তার সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারনা আপনি করে ফেলবেন, পরবর্তী মিনিটগুলোতে তার সাথে আপনার আচরণ কেমন হবে তার একটা পরিকল্পনা আপনা আপনি মাথার মাঝে তৈরি হয়ে যাবে।
বাহ্যিক সৌন্দর্য্যের অন্যতম একটি উপাদান হচ্ছে সুন্দর করে কথা বলা । আপনার ব্যক্তিত্বের একটি বড় অংশ হল কথা বলার ধরন । আপনি হয়ত দেখতে সুন্দর না, আপনার হয়ত অনেক সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, হয়ত আপনি শারীরিকভাবে অসম্পূর্ণ, এই সবকিছুকে ছাপিয়ে আপনাকে সকলের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে পারে শুধুমাত্র আপনার সুন্দর করে কথা বলা । সুন্দর করে কথা বলতে পারার সবচেয়ে পজেটিভ দিকগুলো হচ্ছে-
১. আত্মবিশ্বাসী থাকা যায়
৩. উদ্যমী হওয়া যায়
৫. অন্যের চোখে ভাল ইম্প্রেশন তৈরি করা যায়
৬. মানুষকে সহজে কনভেন্সড করতে পারা যায়
আপনি যদি একজন সফল মানুষ হতে চান- সবার আগে এই সবকটি গুন আপনার মধ্যে থাকাটা জরুরী ।
এবার একটু দেখি সুন্দর করে কথা না বলতে পারলে কি হয়-
বিশাল বর তালিকার কয়েকটি মাত্র তুলে ধরছি-
১. আপনাকে সবাই ভুল বুঝবে
৩. হতাশা তৈরি হবে
৪. মানসিক অশান্তি সৃষ্টি হবে
৫. ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খেতে থাকবেন
সুন্দর করে কথা বলাটা যে খুব বেশি কঠিন এমনটা নয় । এর জন্য একটু সচেতন হওয়া এবং কিছুদিন অন্তত নিজের কথা বলায় একটা ফিলটার বসিয়ে চর্চা করা- কোন কথাটা আপনি বলবেন, আর কোনটা বলবেন না । একবার ভেবে দেখুন, এই এক সুন্দর করে কথা বলাটা যদি আপনাকে এতোগুলো সুবিধা দিতে পারে, আপনি কি তার জন্য সামান্য এইটুকু কষ্ট করতে পারবেন না?
১। হাসিমুখে কথা বলা : প্রথমেই আপনাকে হাসি মুখে কথা বলতে হবে। যে কোন মানুষকে সবচে সুন্দর লাগে যখন সে হাসে। একবার ভাবুন তো, কোন দোকানে আপনার যেতে ভাল লাগে? যে সব সময় হাসি মুখে আন্তরিকতার সাথে কথা বলে? নাকি যে সব সময় গুমোট হয়ে মুখ অন্ধকার করে বসে থাকে? অথবা চোখ বন্ধ করে একবর ভাবুন তো কোন মানুষগুলোকে আপনার ভাল লাগে? দেখবেন হাসি মুখে থাকা মানুষগুলোই আপনার ভাল লাগার যায়গা দখল করে আছে। তাই সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত এই অসম্ভব গুনতিকে ব্যবহার করুন।
২। ইতিবাচক কথা : দৈনন্দিন কথার মাঝে কখনই কোন নেতিবাচক কথা ব্যবহার করবেন না। কারণ নেতিবাচক কথা হতাশা সৃষ্টি করে এবং শূন্যতা তৈরি করে। একবার এক ম্যারেজ কাউন্সিলরের কাছে এক দম্পতি গিয়েছেন পারিবারিক সমস্যা নিয়ে। ম্যারেজ কাউন্সিলরের তাদের সাথে কথা বলে জানলেন, প্রতিদিন মহিলা তার স্বামীকে বাজার প্রসঙ্গে বলে চাল নেই, চিনি নেই, সবজি নেই, মাছ নেই। এই নাই নাই শুনতে শুনতে ভদ্রলোক একটি শূন্যতা অনুভব করেন। তখন ম্যারেজ কাউন্সিলর পরামর্শ দিলেন এখন থেকে কথাগুলো একটু ঘুরিয়ে বলতে। ’নাই’ এর জায়গায় বলবেন ’লাগবে’। কিন্তু এই কথাগুলোই যদি মহিলা এভাবে বলতেন, চাল লাগবে, চিনি লাগবে, সবজি লাগবে তাহলে সংসারের অশান্তি অনেক কমে যেত। কারণ নেই শব্দটির চেয়ে লাগবে শব্দটি ইতিবাচক এবং এটি ভালো অনুরণন সৃষ্টি করে।
৩। বিতর্ক পরিহার করুন : বিতর্ক মানেই আরেক পক্ষকে হেয় করা। হেয় বা অসম্মান করে আসলে কখনও কারো হৃদয়কে জয় করা যায় না। বুদ্ধিমান মানুষ কখনও বিতর্কে লিপ্ত হয় না বরং তারা বুদ্ধিকে ব্যবহার করে বিতর্ক এড়ানোর জন্যে। আমরা মনে করি একটু রাগ না দেখালে কেউ পাত্তা দেবে না। অথবা অহেতুক চিৎকার-চেঁচামেচি না করলে আমার দাম কমে যাবে। ইতিহাস কিন্তু উল্টোটাই সাক্ষ্য দেয়। তাই বিতর্ক সবসময় এড়িয়ে চলবেন।
৪। বিদ্রূপের জবাব দিন বিনয়ে :
রবীন্দ্রনাথ তার গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্যে নোবেল পুরষ্কার পান ১৯১৩ সালে। পশ্চিমাদের অনেকেরই এটা সহ্য হচ্ছিলো না। একবার এক পশ্চিমা সাহেব রবীন্দ্রনাথকে বলেই বসলেন,গীতাঞ্জলি বইটি দারুন হয়েছে। কে আসলে ওটা লিখে দিয়েছিলো তোমার হয়ে। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলো কবিগুরুর বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর, তার আগে বলো দেখি, কে আসলে তোমাকে পড়ে দিয়েছিলো, গীতাঞ্জলির মতো কাব্য।
৫। স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করে কথা বলা : জজ বার্নাড’শ একবার আমেরিকায় লেকচার প্রদানকালে শ্রোতাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ফিফটি পারসেন্ট আমেরিকানস আর ইডিয়েট। বলতেই সভাস্থলে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। এটা লক্ষ্য করেই বার্নাড,শ বললেন, ফিফটি পারসেন্ট আমেরিকান আর ওয়াইজ। অর্থাৎ শতকরা পঞ্চাশ জন আমেরিকান হচ্ছে বিজ্ঞ ব্যক্তি। বলতেই সভাস্থলে গুঞ্জন কমে এলো।
তাই কি বলছেন ও কাকে বলছেন কথা বলার সময় সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
৬। বলুন কম, শুনুন বেশি : স্রষ্টা মানুষকে দুটো কান দিয়েছেন এবং একটি মুখ দিয়েছেন। অতএব শুনতে হবে বেশি এবং বলতে হবে কম। তাই বলার আগে সচেতন হোন কখন, কাকে কী বলে ফেলেছেন। কথা বলার চেয়ে শোনার প্রতি বেশি মনোযোগী হোন। কারণ ভালো বক্তার চেয়ে ভালো শ্রোতা অন্যকে বেশি আকৃষ্ট করে। মনে রাখবেন জ্ঞানী কথা বলেন, প্রজ্ঞাবান শোনেন।
৯। শব্দভান্ডার বাড়ানঃ হোক বাংলা কিংবা ইংরেজি, সব ভাষার ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত শব্দ জানা আবশ্যক। এতে করে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না যে এই শব্দের পর আপনি অন্য কোন শব্দ ব্যবহার করবেন। আমরা দৈনন্দিন জীবনে যেসব শব্দ ব্যবহার করি, বাংলা অভিধান খুলে তার সমার্থক শব্দগুলো দেখে নিতে পারেন। অথবা এমন অনেক শব্দ খুঁজে নিতে পারেন যেগুলো সাধারণ কথায় আমরা খুব কমই ব্যবহার করি, এবং তা প্রয়োগ করুন উপযুক্ত ক্ষেত্রে বুঝে। এতে আপনার কথা যেমন সুন্দর হবে তেমনি শ্রোতার মনে আপনার জ্ঞান সম্পর্কে ভাল ধারনা জন্মাবে।
৭.অঙ্গভঙ্গিঃ
আপনার কথার মুল্য অনেকগুন বাড়িয়ে দিতে পারে সঠিক বডি ল্যাংগুয়েজ। আপনার এক্সপ্রেশন, দাঁড়ানো বা বসার ভঙ্গি, হাত নাড়ানো এসব দিকে মনযোগ দিন। কোন কিছুই অতিরিক্ত করার দরকার নেই। তবে কথার সাথে যেন অঙ্গভঙ্গি খাপ খায় সে চেষ্টা করুন। অনেকের অভ্যাস থাকে অন্যের সাথে কথা বলার সময় কাঁধে হাত দেয়া, বা বারবার গায়ে খোঁচা দিয়ে নিজের দিকে মনযোগ ফেরানোর। আপনার যদি এমন কোন অভ্যাস থেকে থাকে, দয়া করে এখনি পরিহার করুন।
৯. শুনুন এবং বুঝুনঃ
শুধু মাত্র আপনিই হড়বড় করে সব বলে যাবেন, এটা স্মার্টনেসের মধ্যে পড়ে না। বরং আপনি যার সাথে কথা বলছেন তার প্রত্যেকটা কথা শোনা এবং বোঝাও স্মার্টনেসের অন্তর্ভুক্ত। কেউ আপনার সাথে কথা বলার সময় তাকান সরাসরি তার দিকে, তার চোখের দিকে। কোন কথা বুঝতে সমস্যা হলে তার ঠোটের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করুন সে কি বলছে। এটাকে বলে ‘লিপ রিডিং’ যেটা কম শ্রবন শক্তির অধিকারী মানুষজন ব্যবহার করে থাকেন। তার কথায় সম্মতি জানান, মাথা বা হাত নেড়ে তাকে বোঝান যে আপনি তার কথা মন দিয়ে শুনছেন। এবং কারো কথা শোনার সময় মন দিয়ে শুনুন এবং তার প্রশ্ন বুঝার চেষ্টা করুন। কারণ প্রশ্ন ঠিকভাবে বুঝলেই কেবল আপনি ঠিক উত্তরটা দিতে পারবেন, এতে অনেক ভুল বুঝাবুঝিও কমবে।
১০. অনুকরণ ও অনুসরণ
অনুসরণ করুন রেডিও বা টিভির সংবাদ উপস্থাপকদের। বিভিন্ন সফল ব্যক্তির কথা বলার ধরন এবং অঙ্গভঙ্গি লক্ষ্য করুন। নিজের কোন প্রিয় অভিনেতাকে অথবা কোন প্রিয় ব্যক্তিত্বকে। যাকে আপনি পছন্দ করেন। জার কথা বলার ধরন আপনাকে আকর্ষণ করে এবং যাকে দেখে আপনার মনে হয় যে আপনি তার মত কথা বলতে পারবেন।
খুব অল্প সময়েই আপনি লক্ষ্য করবেন আপনি আগের চেয়ে অনেক সুন্দর কথা বলতে পারছেন এবং ধীরে ধীরে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছেন ।
Leave a Reply