একজন কিংবদন্তী অভিনেতা। সারা বিশ্বে যার রয়েছে কোটি কোটি ভক্ত। হ্যা আমরা আজ জ্যাকি চ্যানের জীবনী তুলে ধরবো আপনাদের সামনে। তুমুল জনপ্রিয় ও অসাধারণ মানবিক ব্যক্তিত্বের একজন মানুষ তিনি। যার প্রতিফলন থাকে তার প্রতিটি কাজে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে- সারা বিশ্বে যে লোকটিকে নিয়ে এতো হৈচৈ-মাতামাতি, তিনি কিনা বরাবরই ইনস্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর কাছে খুবই অবহেলিত থাকেন !
কি অবাক হচ্ছেন? অবাক হওয়ার মতই ব্যাপার।
ইনস্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর চোখে জ্যাকি চ্যানের জীবন সবচেয়ে অনিশ্চিত জীবন !
কারণ লোকটি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বারবার হাজির হন সিনেমার পর্দায়। সিনেমায় তার যে অবিশ্বাস্য একশান সিনগুলো দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়, সেই সিনগুলো বাস্তবিক অর্থে তিনি নিজেই করেন। আর এসব কারনেই ইনস্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর চোখে সবচেয়ে অনিশ্চিত জীবন তার। কে খামোখা চাইবে, একজন রিস্কি মানুষের ইনস্যুরেন্স করতে?
তার চলচ্চিত্রগুলোতে তিনি শারীরিক কসরতপূর্ণ মারামারির দৃশ্য, হাস্যরসাত্মক ভঙ্গি, অপ্রচলিত অস্ত্রের ব্যবহার ও স্টান্ট দৃশ্যের জন্য সুপরিচিত। ষাটের দশক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন এই অভিনেতা। তাঁর অভিনেতা পরিচয় তাঁকে হং কং অ্যাভিনিউ অফ স্টার ও হলিউড ওয়াক অফ ফেম এ স্থান করে দিয়েছে।
অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি একজন পপ সঙ্গীতশিল্পী। এছাড়াও তাঁর অভিনিত অনেক চলচ্চিত্রের থিম সঙ্গীতেও তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন। বাস্তব উপস্থিতির পাশাপাশি অনেক কার্টুন ও ভিডিও গেমেও তার উপস্থিতি বিদ্যমান।
জ্যাকি চ্যান যখন জন্মান তখন তাঁর বাবা তাকে বিক্রি করে হসপিটালের টাকা পেইড করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
চীনে নির্মিত পুলিশ স্টোরি, আর্মার অব গড’এর মত জনপ্রিয় ছবিতে যেমন তিনি অভিনয় করেছেন তেমনই হলিউডেও তিনি সফল ! সাংহাই নুন, রাশ আওয়ার, দ্য কারাতে কিড, অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ, দ্য ফরবিডেন কিংডম ইত্যাদি ছবি বিশ্বজুড়ে আলোচিত হয়।
আজ বলবো মহান এই চলচ্চিত্র অভিনেতার শূন্য থেকে আকাশ ছোঁয়ার গল্প। কীভাবে তিনি গরীব পরিবার থেকে এসে বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতকে শাসন করে চলছেন।
জ্যাকি চ্যান কিন্তু একজন পপ সঙ্গীতশিল্পী। তাঁর অভিনিত অনেক চলচ্চিত্রের থিম সঙ্গীতে তিনি নিজে কণ্ঠ দিয়েছেন ।
জ্যাকি চ্যান ১৯৫৪ সালের ৭ই এপ্রিল হংকংয়ে জন্মগ্রহণ করেন । মা বাবা তার নাম রেখেছিলেন চ্যাং কং স্যাং, যার অর্থ- হং কংয়ে জন্ম । জ্যাকি চ্যানের যখন জন্ম হয় তখন তার বাবার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ । তিনি জ্যাকি চ্যানকে বিক্রি করে হসপিটালের টাকা পেইড করার সিদ্ধান্ত নেন ।
কিন্তু জ্যাকির বাবার এক বন্ধু এসে তাকে বাধা দেয় । ছোটবেলা থেকেই জ্যাকির বাবা প্রতিদিন ভোরে তাকে কোং ফু শেখানোর জন্য নিয়ে যেতেন । তার বাবার বিশ্বাস ছিল, কোং ফু জ্যাকির চরিত্র গঠন থেকে শুরু করে ধৈর্য ধারণ ও শক্তি সামর্থ্যকে বাড়িয়ে তুলবে, আর সে হবে অনেক বেশি সাহসী ।
মাত্র ৭ বছর বয়সে জ্যাকি চায়না ড্রামা একাডেমীতে অভিনয় করার সুযোগ পান । তারপর সেখানেই কাটে তার জীবনের পরবর্তী ১০ টি বছর । যে বয়সে তার স্কুলে পড়ার কথা, তখন তিনি মার্শাল আর্টের যতসব জটিল শারীরিক কসরত আয়ত্তে আনার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন । আর সাথে ছিল গান ও অভিনয় ।
আসলে এই স্কুলের উদ্দেশ্য ছিল অপেরার জন্য প্রস্তুত করা । ছাত্ররা কোন নির্দেশনা অমান্য করলে বা কোন ভুল করলে স্কুলে বেদম প্রহার করা হত তাদের । দেখা যেত, বছরের পর বছর বাবা মাকে একটি পলকের জন্যও দেখার সুযোগ ছিল না তখন, বা দেখা হলেও তা হত খুব অল্প সময়ের জন্য ।
তিনি কনন্ট্রাকশনের মতো কঠোর পরিশ্রমের কাজে যুক্ত হন, আর এখানেই তার নতুন নাম হয় জ্যাকি ।
স্কুলে পড়ার সময় ৮ বছর বয়সে প্রথম সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ পান তিনি । ১৭ বছর বয়সে তিনি চায়না ড্রামা একাডেমী থেকে গ্র্যাজুয়েট হন । কিন্তু সমস্যা হল, যেই অপেরার জন্য এতোবছর স্কুলে সাধনা করেছিলেন, ততদিনে চাইনিজ অপেরা আর আগের মত জনপ্রিয়তায় নেই । তাই গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর জ্যাকি ও তার সহপাঠী বন্ধুরা অপেরায় না গিয়ে অন্য কাজ খুঁজতে শুরু করেন । কিন্তু তাদের জন্য অন্য কোন কাজ জোগাড় করাটা ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জিং কাজ কেননা, তাদের স্কুলে কখনো পড়ালেখার বাইরে কিছুই শেখানো হয়নি ।
উপার্জনের জন্য তখন একটা মাত্র পথ সামনে খোলা ছিল- সেটা হল, স্টান পারফর্ম অথবা এমন কোন কাজ করা যার জন্য কোন দক্ষতার প্রয়োজন হয় না । পরবর্তী কয়েকবছর ধরে জ্যাকি স্টানম্যান হিসেবে কাজ করেন কিন্তু হং কং চলচ্চিত্র শিল্পের দুরবস্থা তৈরি হলে বাবা মায়ের চাপের মুখে পড়ে তাকে তাদের কাছে অস্ট্রেলিয়া চলে যেতে হয় ।
তিনি কনন্ট্রাকশনের কাজে যুক্ত হন, আর এখানেই তার নতুন নাম হয় জ্যাকি । যদিও জ্যাকি অস্ট্রেলিয়াতে মন বসাতে পারছিল না কোনভাবেই কারণ কনন্ট্রাকশনের কাজ করা তার কাছে খুব কঠিন ও একঘেইয়েমি লাগছিল ।
এই সময়ই যেন শাস্তি থেকে মুক্তি দিতে তার কাছে দেবদূতের মত হাজির হন উইলি চ্যান নামের এক ভদ্রলোক । উইলি চ্যান হং কং চলচ্চিত্রে কাজ করতেন । তিনি তার নতুন সিনেমার জন্য লোক খুঁজছিলেন । সৌভাগ্যবশত জ্যাকি চ্যানের স্টান চোখে পড়ে উইলির আর ভীষণ মুগ্ধ হন তিনি । তারপর জ্যাকি চ্যান পুরনায় হং কং ফিরে আসেন সিনেমার কাজ করার জন্য ।
১৯৭৬ সাল, যখন জ্যাকি চ্যানের বয়স ২১ বছর, তখন তাঁর প্রথম ছবি মুক্তি পায় । কিন্তু জ্যাকির এই সিনেমাটি খুব একটা সফলতার মুখ দেখতে পায় না । এর কারণ ছিল, সিনেমায় জ্যাকি চ্যানের প্রতিভা ঠিকমতো উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হন এর পরিচালক ।
১৯৭৮ সালে Snake in the Eagle’s Shadow মুভিতে প্রথম মূল চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান তিনি। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন ভাষার প্রায় দুই শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি এবং প্রতি বছরই এই সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে! তিনি মার্শাল আর্টের মধ্যে কৌতুক নিয়ে এসে নতুন এক ধারা প্রবর্তিত করে চমকে দেন সবাইকে ।
> আপনি যদি জ্যাকি চ্যানের একজন বড় ফ্যান হয়ে থাকেন, তাহলে জ্যাকি চ্যান সম্পর্কে এই বিষয়গুলো আপনাকে দারুণ মুগ্ধ করবেঃ
১. জ্যাকি চ্যান তার জীবনে যা টাকা আয় করেছেন সে তার ১ ভাগও তার ছেলে জেসি চ্যানের জন্য রাখবেন না। জ্যাকির মতে যদি আমার ছেলের যোগ্য হয় তাহলে সে নিজেই তার পথ তৈরি করে নিতে পারবে। আর যদি সে নিজে কিছু করতে না পারে আর আমার টাকার প্রয়োজন হয় তার মানে সে আমার টাকা নষ্ট করে ফেলবে। তার চেয়ে ভালো আমি আমার সব টাকা অসহায় শিশুদের পিছনে ব্যয় করবো।
২. জ্যাকি চ্যানের সাথে একদিন কয়েকজন বাইকারের সাথে ফাইট হয়। ফাইট শেষে আঘাত পায় জ্যাকি। ২ দিন ধরে জ্যাকির হাতে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। একদিন জ্যাকি হাতের মধ্যে চাপ দিয়ে দেখে তার হাতের ভিতরে একজনের দাঁত।
৩. ক্যারিয়ারের গোড়ার দিকে অভিনয়ের প্রতি জ্যাকি এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন যে কাজের জন্য দিনে মাত্র ২ ঘণ্টা ঘুমাতেন। তাও আবার অভিনয়ের ফাঁকেই সেই ঘুম সেরে নিতেন।
৪. Dragon Lord (1982) মুভির শাটালকক ম্যাচের একটি ১০ মিনিটের দৃশ্যের জন্য জ্যাকি চ্যান মোট ২৯০০টি শট নিয়েছিল। যা যেকোন পরিচালকের নেয়া সবচেয়ে বেশি শটস।
৫.ব্রুস লির মুভি Enter The Dragon (1973) এর একটি দৃশ্যে ব্রুস লি লাঠি দিয়ে জ্যাকি চ্যানকে আঘাত করে। কিন্তু লাঠির জোর বেশি থাকায় ব্যথা পান জ্যাকি। তারপর শট শেষে দৌড়ে গিয়ে ব্রুস লি জ্যাকি চ্যানকে বুকে নিয়ে বলতে থাকে ‘I’m sorry, i’m sorry’।।
সেটা জ্যাকি চ্যানের মতে তার জীবনের সবচেয়ে ভালো মুহূর্ত। মাত্র ১৯ বছর বয়সে প্রিয় তারকার সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ অনেক বেশি আনন্দ দিয়েছিল জ্যাকিকে।
৬. ছুরি, চাকু কিংবা তলোয়ারের সামনে দাঁড়াতে ভয় না পেলেও সুঁচকে বড় ভয় জ্যাকির। নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ত্বকে সুঁচ ফোটানোর মত ভয়াবহ ব্যাপার তার জীবনে খুব কমই রয়েছে।
৭. জ্যাকি চ্যানের জীবনে একাধিক নারী আসলেও মন যাকে দিয়েছিলেন তিনি জোয়ান লিন। হংকংয়ের বিখ্যাত এই অভিনেত্রীও মন উজাড় করেই জ্যাকি’কে ভালোবাসেন। আর সে জন্যই খ্যাতির তুঙ্গে থাকাকালে শুধু জ্যাকির ঘরণী হতেই তিনি অভিনয় ছেড়ে দেন। ১৯৮২ সালে জ্যাকি চ্যানকে বিয়ে করেন তিনি। এখনও তিনি জ্যাকির সংসার নিয়েই আছেন।
এই ঘটনাকে জ্যাকি চ্যান ‘Only committed a fault that many men in the world commit’ বলে অভিহিত করেন। তখন থেকেই Etta (বর্তমান বয়স ১৭) তার মা Elaine-র সাথেই থাকেন।
সবার প্রিয় এই অভিনেতার দারুণ একটি কথা দিতেই আজকের মতো সমাপ্তি টানবোঃ